হয়তো থেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে জলের তর্জন-গর্জন! কারণ সাগরিকার ২২ গজের শক্ত মাটিতে টাইগারদের গর্জনে উঠে গেছে ঢেউ। এমন ঘটনা আরব্য রজনীর রূপকথাতেই হয়তো সম্ভবপর হতে পারে। আফিফ হোসেন ধ্রুব আর মেহেদি হাসান মিরাজ রেকর্ড বুক তোলপাড় করা ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বুধবার চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। পয়মন্ত এ ভেন্যুতে আফগানিস্তানের ৪৯.১ ওভারে করা ২১৫ রানের জবাবে নেমে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। তখনও ১৭১ রান প্রয়োজন অসম্ভব হয়ে পড়া জয় ছুঁতে। কিন্তু রান তাড়ায় ১৭৪ রানের বিশ^রেকর্ড গড়া অবিচ্ছিন্ন জুটিতে বাংলাদেশকে ৭ বল বাকি থাকতেই ৪ উইকেটের জয় পাইয়ে দেন আফিফ-মিরাজ। ৪৮.৫ ওভারে ৬ উইকেটে ২১৯ রান তোলে বাংলাদেশ। এত কম রানে ৬ ব্যাটারকে হারিয়েও জয়ের ঘটনা ৪৭ বছর আগের এক রেকর্ডকে পেছনে ফেলেছে। ৩ ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়ে চলমান আইসিসি ওয়ানডে বিশ^কাপ সুপার লীগে এখন ৯০ পয়েন্ট বাংলাদেশের। আরেকটি ম্যাচ জিতলেই সুপার লীগে ইংল্যান্ডকে হটিয়ে শীর্ষে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। এমন অবিস্মরণীয় জয়ের জন্য তাইতো টাইগার অধিনায়ক তামিম ইকবাল স্বপ্ন দেখছেন ভেবে নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কাটছেন এবং তার সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমি বিশ^াস করতে পারছি না!
সত্যিই এক অনন্য রূপকথার জন্ম দিয়েছে টাইগাররা। ৫০ রানের মধ্যেই ৬ উইকেট হারানো কোন দল অবিচ্ছিন্ন সপ্তম উইকেট জুটির কল্যাণে সর্বশেষ জয় তুলে নিয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৮ জুন। লিডসে সেবার স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে এই দুঃসহ স্মৃতি উপহার দিয়েছিল সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার গ্যারি গিলমোর ও ডগ ওয়াল্টার্স জুটি ৫৫ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে। তবে সেবার অসিদের লক্ষ্য ছিল মাত্র ৯৪ রানের এবং তারা ৩৯ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর জয় তুলে নেয়। এবার ৪৭ বছর পর আফিফ-মিরাজ যে ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তা একেবারেই কীর্তিতে অবাস্তব ঘটনার মতো। ৫০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারানো কোন দলই আর বাকি ৪ উইকেট অক্ষত রেখে জিততে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে পরে ব্যাট করে জয়ের ঘটনাই মাত্র ওয়ানডে ইতিহাসে ৪টি। যার মধ্যে অসিদের জয়ই ছিল সেরা, এবার অনেক তফাতে হটে গেছে তাদের সেই কীর্তি বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় অর্জনের কাছে। এমন কীর্তি গড়ার দিনটি সম্পর্কে জানতে কিছুটা পেছনে যেতে হবে। দীর্ঘ ৭ মাস পর ওয়ানডে ক্রিকেটে ফেরা বাংলাদেশ টস হেরে যায়। আফগানরা ব্যাট হাতে নেয়ার পর শুরুটা তারা দারুণ করে ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই মুস্তাফিজুর রহমানকে বিধ্বংসী রহমানুল্লাহ গুরবাজ বাউন্ডারি হাঁকালে। এরপর অবশ্য খুব বেশিদূর যেতে পারেননি তিনি। তৃতীয় ওভারে গুরবাজ ৭ রানেই মুস্তাফিজের শিকার হন। এরপর অবশ্য ৪৫ রানের জুটি ইব্রাহিম জাদরান ও রহমত শাহর। কিন্তু রহমত ৬৯ বলে ৩৪ রানে আউট হওয়ার পর আফগানদের আরও চেপে ধরে বাংলাদেশের বোলাররা। বিশেষ করে মেহেদি হাসান মিরাজের দারুণ লাইন-লেন্থের সামনে রান তুলতে হিমশিম খেয়েছেন আফগান ব্যাটাররা। তিনি ১০ ওভারে ৩ মেডেন দিয়ে মাত্র ২৮ রান খরচা করেন। ৪৩টি ডট দিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে নাজিবুল্লাহ জাদরান ৮৪ বলে ৪ চার, ২ ছক্কায় ৬৭ রান করলেও ৫ বল বাকি থাকতেই গুটিয়ে যায় ২১৫ রানে। মুস্তাফিজ ৩টি এবং সাকিব আল হাসান, তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম ২টি করে উইকেট নেন। মুস্তাফিজ ১৩০ উইকেট নিয়ে সতীর্থ রুবেল হোসেন (১২৯) ও ভারতের রবি শাস্ত্রীকে পেছনে ফেলেন।
জবাব দিতে নেমে সদ্যই সমাপ্ত বিপিএলে ভাল বোলিং করলেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি। কিন্তু ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নেমে ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করেন। বাঁহাতি এ পেসার তামিম ইকবাল (৮), লিটন দাস (১), মুশফিকুর রহিম (৩) ও অভিষিক্ত লোকাল বয় ইয়াসির রাব্বিকে (০) সাজঘরে ফিরিয়ে রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে ওঠেন। তার সঙ্গে অফস্পিনার মুজিব উর রহমান ও লেগস্পিনার রশিদ খানের ভয়ানক ঘূর্ণি যোগ হলে ৫ ওভারে দলীয় ১৮ রানে ৪ এবং ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে নিশ্চিত পরাজয়ের প্রহরকে আলিঙ্গনের অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশ। তখনই রুখে দাঁড়ান আফিফ ও মিরাজ। আগে যা করতে পারেননি তারা এবার সেটাই করেছেন। আগের ৭ ইনিংসে ৪৫ রানের সেরা ইনিংস খেলা আফিফ মাত্র ৬৪ বলেই প্রথম ফিফটি পেয়ে যান। আর মিরাজ ক্যারিয়ারের তৃতীয় ওয়ানডেতে প্রথম ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে ২০১৭ সালে কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫১ রান করার পর গত ৩১ ইনিংসে ছিলেন নিষ্প্রভ। এবার দ্বিতীয় ফিফটি হাঁকিয়েছেন ৭৯ বলে। এরপরও থামেননি। বাংলাদেশকে অবিশ^াস্য জয় এনে দিয়েছেন ১৭৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে ৭ বল বাকি থাকতেই। ৪৮.৫ ওভারে ৬ উইকেটে ২১৯ রানের মধ্যে মিরাজের ১২০ বলে ৯ চারে ৮১ ও আফিফের ১১৫ বলে ১১ চার, ১ ছক্কায় ৯৩ রানের দুটি অপার্থিব, অপরাজেয় ইনিংস রয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত ৬ উইকেট যাওয়ার পরেও রান তাড়া করে বাকি উইকেট অক্ষত রেখে জেতার ক্ষেত্রে বিশ^রেকর্ড। এর আগে ডাম্বুলায় ভারতের বিপক্ষে ডাম্বুলায় জয়াবর্ধনে-চন্দনা ১২৬ রানে অবিচ্ছিন্ন থেকে শ্রীলঙ্কাকে জিতিয়েছিলেন ২০০৫ সালে। ফজল ৫৪ রানে ৪ উইকেট নেন।
আটে নেমে এমন পরিস্থিতিতে দলকে জেতানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস খেলার বিশ^রেকর্ড গড়েছেন মিরাজ। তাইতো হয়েছেন ম্যাচের সেরা। সাগরিকায় পরে ব্যাট করে হারের রেকর্ড বিরল বাংলাদেশের। এই ভেন্যুতে বুধবারের আগে ২০ ম্যাচ খেলে টাইগারদের পাওয়া ১৩ জয়ের দশটিই এসেছে রান তাড়া করে। অর্থাৎ পরে ব্যাট করেই বেশি জিতেছে বাংলাদেশ দল। এবারও জিতল, তবে অবিশ^াস্য এক কা- ঘটিয়ে এবং বিশ^রেকর্ড গড়ে। তাই অধিনায়ক তামিম বলেন, ‘৪৫ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর জিতেছি এটা বিশ^াস করতে পারছি না। কিন্তু আমি খুবই গর্বিত এবং সন্তুষ্ট যেভাবে তারা দুজন অসাধারণ ইনিংস খেলেছে।’ আফিফও তাই গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘দেশের জন্য ভাল খেলাটা সবসময় গর্বের একটা ব্যাপার। আজকে যেহেতু বড় একটা সুযোগ ছিল, এরকম বড় সুযোগ পাওয়া যায় না। বড় সুযোগ পেয়েছি এটা কাজে লাগাতে চেয়েছি।’ আর এতেই রেকর্ডবুকে তেলেসমাতি কা- ঘটিয়ে বাংলাদেশকে জিতিয়ে দিয়েছেন আফিফ-মিরাজ। বাংলাদেশ সিরিজে এগিয়ে গেছে ১-০ ব্যবধানে। আরেকটি ম্যাচ জিতলে শুধু সিরিজ জয়ই নয়, ১০০ পয়েন্ট নিয়ে ইংল্যান্ডকে পেছনে ফেলে সুপার লীগে শীর্ষে উঠে যাবে টাইগাররা।
Leave a Reply