আজ ২০শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ :

শবে মেরাজের বর্ণিল সাজে অনুপ্রাণিত হোক মুসলিম উম্মহর হৃদয় ক্যানভাস

মুফতি সরওয়ার হোসাইন
আরবিতে “লাইলাতুল মেরাজ” শব্দটি যৌগিক (مركب) ‘লাইলাতুন’ অর্থ রাত,আর ‘মেরাজ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে- সিঁড়ি বা সোপান,ঊর্ধ্বে আরোহণ,ওপরে ওঠা,ঊর্ধ্বগমন। মহিমান্বিত বরকতময় এই রজনী উপমহাদেশে” শবে মেরাজ” হিসাবে সমধিক পরিচিত। প্রিয়নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ২৬ রজব দিবাগত রাতে পবিত্র নগরী মক্কা থেকে ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘তিনি পবিত্র যিনি তার বান্দাকে (রাসুলকে) এক রাতে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন। তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য যার (মসজিদে আকসার) চারপাশকে আমি বরকতময় করেছিলাম। তিনি সবকিছু শোনেন এবং দেখেন’। (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১)

মেরাজের তৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় বিশ্বনবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-র সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা প্রতিভাত হয়েছে। মেরাজের এ ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের আক্বিদা-বিশ্বাসের অন্যতম অংশ।মেরাজের ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
বিশ্বনবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মেরাজ প্রসঙ্গে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছ যাতে অনেক ভিত্তিহীন বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে, যা মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। মেরাজের সঠিক তথ্য ও ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হয় ঈমানদার মুমিন মুসলমান। প্রেক্ষিতে, মেরাজ সম্পর্কিত বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিস নিম্নে পেশ করা হলো-

حدثنا هدبة بن خالد: حدثنا همام بن يحيى: حدثنا قتادة، عن أنس بن مالك، عن مالك بن صعصعة رضي الله عنهما:

أن نبي الله ﷺ حدثهم عن ليلة أسري به: (بينما أنا في الحطيم، وربما قال في الحجر، مضطجعا، إذ أتاني آت فقد – قال: وسمعته يقول: فشق – ما بين هذه إلى هذه – فقلت للجارود وهو إلى جنبي: ما يعني به؟ قال: من ثغرة نحره إلى شعرته، وسمعته يقول: من قصهإلى شعرته – فاستخرج قلبي، ثم أتيت بطست من ذهب مملوءة إيمانا، فغسل قلبي، ثم حشي ثم أعيد، ثم أتيت بدابة دون البغل وفوق الحمار أبيض – فقال له الجارود: هو البراق يا أبا حمزة؟ قال أنس: نعم – يضع خطوه عند أقصى طرفه، فحملت عليه، فانطلق بي جبريل حتى أتى السماء الدنيا فاستفتح، فقيل: من هذا؟ قال: جبريل، قيل: ومن معك؟ قال: محمد، قيل: وقد أرسل إليه؟ قال: نعم، قيل: مرحبا به فنعم المجيء جاء ففتح، فلما خلصت فإذا فيها آدم، فقال: هذا أبوك آدم فسلم عليه، فسلمت عليه، فرد السلام، ثم قال: مرحبا بالابن الصالح والنبي الصالح، ثم صعد حتى إذا أتى السماء الثانية فاستفتح، قيل: من هذا؟ قال: جبريل، قيل: ومن معك؟ قال: محمد، قيل: وقد أرسل إليه؟ قال: نعم، قيل: مرحبا به فنعم المجيء جاء ففتح، فلما خلصت إذا يحيى وعيسى، وهما ابنا الخالة، قال: هذا يحيى وعيسى فسلم عليهما، فسلمت فردا، ثم قالا: مرحبا بالأخ الصالح والنبي الصالح، ثم صعد بي إلى السماء الثالثة فاستفتح، قيل: من هذا؟ قال: جبريل، قيل: ومن معك؟ قال: محمد، قيل: وقد أرسل إليه؟ قال: نعم، قيل: مرحبا به فنعم المجيء جاء ففتح، فلما خلصت إذا يوسف، قال: هذا يوسف فسلم عليه، فسلمت عليه، فرد ثم قال: مرحبا بالأخ الصالح والنبي الصالح، ثم صعد بي حتى أتى السماء الرابعة فاستفتح، قيل: من هذا؟ قال: جبريل، قيل: ومن معك؟ قال: محمد، قيل: أو قد أرسل إليه؟ قال: نعم، قيل: مرحبا به، فنعم المجيء جاء ففتح، فلما خلصت إلى إدريس، قال: هذا إدريس فسلم عليه فسلمت عليه، فرد ثم قال: مرحبا بالأخ الصالح والنبي الصالح، ثم صعد بي، حتى إذا أتى السماء الخامسة فاستفتح، قيل: من هذا؟ قال: جبريل، قيل: ومن معك؟ قال: محمد ﷺ ، قيل: وقد أرسل إليه، قال: نعم، قيل: مرحبا به، فنعم المجيء جاء، فلما خلصت فإذا هارون، قال: هذا هارونفسلم عليه، فسلمت عليه، فرد ثم قال: مرحبا بالأخ الصالح، والنبي الصالح، ثم صعد بي حتى إذا أتى السماء السادسة فاستفتح، قيل: من هذا؟ قال: جبريل، قيل: من معك؟ قال: محمد، قيل: وقد أرسل إليه؟ قال: نعم، قال: مرحبا به، فنعم المجيء جاء، فلما خلصت فإذا موسى، قال: هذا موسى فسلم عليه فسلمت عليه، فرد ثم قال: مرحبا بالأخ الصالح، والنبي الصالح، فلما تجاوزت بكى، قيل له: ما يبكيك؟ قال: أبكي لأن غلاما بعث بعدي يدخل الجنة من أمته أكثر ممن يدخلها من أمتي، ثم صعد بي إلى السماء السابعة فاستفتح جبريل، قيل: من هذا؟ قال: جبريل، قيل: ومن معك؟ قال: محمد، قيل: وقد بعث إليه، قال: نعم، قال: مرحبا به فنعم المجيء جاء، فلما خلصت فإذا إبراهيم، قال: هذا أبوك فسلم عليه، قال: فسلمت عليه فرد السلام، قال: مرحبا بالابن الصالح والنبي الصالح، ثم رفعت لي سدرة المنتهى فإذا نبقها مثل قلال هجر، وإذا ورقها مثل آذان الفيلة، قال: هذه سدرة المنتهى، وإذا أربعة أنهار: نهران باطنان ونهران ظاهران، فقلت: ما هذان يا جبريل؟ قال: أما الباطنان فنهران في الجنة، وأما الظاهران فالنيل والفرات، ثم رفع لي البيت المعمور، يدخله كل يوم سبعون ألف ملك. ثم أتيت بإناء من خمر وإناء من لبن وإناء من عسل، فأخذت اللبن فقال: هي الفطرة أنت عليها وأمتك، ثم فرضت علي الصلوات خمسين صلاة كل يوم، فرجعت فمررت على موسى، فقال: بم أمرت؟ قال: أمرت بخمسين صلاة كل يوم، قال: أمتك لا تستطيع خمسين صلاة كل يوم، وإني والله قد جربت الناس قبلك،
وعالجت بني إسرائيل أشد المعالجة، فارجع إلى ربك فاسأله التخفيف لأمتك، فرجعت فوضع عني عشرا، فرجعت إلى موسى فقال مثله، فرجعت فوضع عني عشرا، فرجعت إلى موسى فقال مثله، فرجعت فوضع عني عشرا، فرجعت إلى موسى فقال مثله، فرجعت فأمرت بعشر صلوات كل يوم، فرجعت فقال مثله، فرجعت فأمرت بخمس صلوات كل يوم، فرجعت إلى موسى، فقال: بما أمرت؟ قلت: أمرت بخمس صلوات كل يوم، قال: إن أمتك لا تستطيع خمس صلوات كل يوم، وإني قد جربت الناس قبلك وعالجت بني إسرائيل أشد المعالجة، فارجع إلى ربك فاسأله التخفيف لأمتك، قال: سألت ربي حتى استحييت، ولكن أرضى وأسلم، قال: فلما جاوزت نادى مناد: أمضيت فريضتي، وخففت عن عبادي).

” বিশিষ্ট তাবি’ঈ হজরত ক্বতাদা হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-হজরত মালিক ইবনু সা’সা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, আল্লাহর নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে রাতে তাকেঁ ভ্রমণ করানো হয়েছে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-এক সময় আমি কাবা ঘরের হাতিমের অংশে ছিলাম। কখনো কখনো রাবী (কাতাদাহ) বলেছেন, হিজরে শুয়েছিলাম। হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার কাছে এলেন এবং আমার এ স্থান থেকে সে স্থানের মাঝের অংশটি (হলকুমের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত) চিরে ফেললেন।তারপর আগন্তুক আমার হৃদপিণ্ড বের করলেন। তারপর আমার কাছে একটি সোনার পাত্র আনা হল যা ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল। তারপর আমার হৃদপিন্ডটি ধৌত করা হল এবং ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে আবার রেখে দেয়া হল।তারপর সাদা রং এর একটি জন্তু আমার কাছে আনা হল। যা আকারে খচ্চর হতে ছোট ও গাধা হতে বড় ছিল। জারুদ তাকে বলেন, হে আবূ হামযা, এটাই কি বুরাক? আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হ্যাঁ’।সে একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ সীমায়। আমাকে তার উপর সওয়ার করানো হল। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরিল আলাইহিস সালাম চললেন।
প্রথম আসমানে নিয়ে এসে (জিবরিল) দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হল, ইনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠান হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যা’। তখন বলা হল, মারহাবা, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর আসমানের দরজা খুলে দেয়া হল। আমি যখন (প্রথম আসমানে) পৌঁছলাম, তখন সেখানে আদম আলাইহিস সালাম-এর দেখা পেলাম। জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম, তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্‌কার পুত্র ও নেক্‌কার নবীর প্রতি খোশ আমদেদ।
দ্বিতীয় আসমানতারপর (সেখান থেকে) উপরের দিকে চলে দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছে (জিবরিল) দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হল কে? তিনি বললেন, জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর বলা হল – মারহাবা! উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে।তারপর (দ্বিতীয় আসমানের দরজা) খুলে দেয়া হল। সেখানে পৌঁছলাম তখন সেখানে ইয়াহ্‌ইয়া ও ‘ঈসা আলাইহিস সালাম-এর দেখা পেলাম। তাঁরা দুই জন ছিলেন একে অপরের খালাত ভাই। তিনি (জিবরিল) বললেন, এরা হলেন, ইয়াহ্‌ইয়া ও ঈসা আলাইহিস সারাম। তাদের প্রতি সালাম করুন। তখন আমি সালাম করলাম। তাঁরা জবার দিলেন, তারপর বরলেন, নেক্‌কার ভাই ও নেক্‌কার নবীর প্রতি খোশ আমদেদ।
তৃতীয় আসমানএরপর (সেখান থেকে) তিনি আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানের দিকে চললেন, সেখানে পৌঁছে জিবরিল বললেন, খুলে দাও। তাঁকে বলা হল কে? তিনি উত্তর দিলেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। বলা হল, তাঁর জন্য খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।তারপর (দ্বিতীয় আসমানের) দরজা খুলে দেয়া হল। আমি সেখানে পৌঁছে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে দেখতে পেলাম। জিবরিল বললেন, ইনি ইউসুফ আলাইহিস সালাম। আপনি তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম, তিনিও জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্‌কার ভাই, নেক্‌কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।

চতুর্থ আসমানতারপর জিবরিল আলাইহিস সালাম আমাকে নিয়ে উপর দিকে চললেন এবং চতুর্থ আসমানে পৌঁছলেন। আর দরজা খুলে দিতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। তখন বলা হল, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে।তারপর (৪র্থ আসমানের দরজা) খুলে দেয়া হল। আমি (সেখানে) ইদরিস আলাইহিস সালাম- এর কাছে পৌঁছলে জিবরিল বললেন, ইনি ইদরিস আলাইহিস সালাম। তাকেঁ সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনিও জবাব দিলেন। তারপর বললেন, নেক্‌কার ভাই ও নেক্‌কার নবীর প্রতি মারহাবা।

পঞ্চম আসমানএরপর তিনি আমাকে নিয়ে উপর দিকে গিয়ে পঞ্চম আসমানে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হল আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। বলা হল, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।সেখানে পৌঁছে হারূন আলাইহিস সালামকে পেলাম। জিবরিল বললেন, ইনি হারূন আলাইহিস সালাম তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম; তিনিও জবাব দিলেন, এবং বললেন, নেক্‌কার ভাই ও নেক্‌কার নবীর প্রতি মারহাবা।

ষষ্ঠ আসমানতারপর আমাকে নিয়ে যাত্রা করে ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রশ্ন করা হল, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যা’। ফেরেশ্‌তা বললেন, তার প্রতি মারহাবা। উত্তম আগন্তুক এসেছেন।সেখানে পৌঁছে আমি মূসা আলাইহিস সালামকে পেলাম। জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি মূসা আলাইহিস সালাম। তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্‌কার ভাই ও নেক্‌কার নবির প্রতি মারহাবা।

আমি যখন অগ্রসর হলাম তখন তিনি (মুসা আলাইহিস সালাম) কেঁদে ফেললেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কিসের জন্য কাঁদছেন? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি যে, আমার পর একজন যুবককে নবি বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, যাঁর উম্মত আমার উম্মত হতে অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে।

সপ্তম আসমানতারপর জিবরিল আলাইহিস সালাম আমাকে নিয়ে সপ্তম আকাশের দিকে গেলেন এবং দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হল এ কে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। বলা হল, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।আমি সেখানে পৌঁছে ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে দেখতে পেলাম। জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি আপনার পিতা তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্‌কার পুত্র ও নেক্‌কার নবির প্রতি মারহাবা।

সিদরাতুল মুনতাহায় আগমন[‘সিদরাহ’ শব্দের অর্থ কূল বৃক্ষ আর ‘মুনতাহা’ শব্দের অর্থ শেষসীমা। পৃথিবী হতে উর্ধ্বলোকে উপনীত হয়ে তা ওখানে গিয়েই থেমে পড়ে।তারপর তার অপর পাড়ে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সেখান হতে তা গ্রহণ করে উপরে নিয়ে যান। শেষ সীমায় চিহ্নস্বরূপ ঐ স্থানটাতে একটা কূল বৃক্ষ থাকায় ঐ সীমান্ত চিহ্নকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ বলা হয়।]

তারপর আমাকে সিদ্‌রাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। (সেখানে) দেখতে পেলাম, তার ফল ‘হাজার’ অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতাগুলি হাতির কানের মত। আমাকে বলা হল, এ হল সিদরাতুল মু্‌নতাহা।

বিশেষ নহর দেখাসেখানে আমি চারটি নহর দেখতে পেলাম। যাদের দুইটি ছিল অপ্রকাশ্য আর দুইটি ছিল প্রকাশ্য। তখন আমি জিব্‌রাঈল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ নহরগুলি কী? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য, দুইটি হল জান্নাতের দুইটি নহর। আর প্রকাশ্য দুইটি হল নীল নদী ও ফুরাত নদী।

বায়তুল মামুন দেখাতারপর আমার সামনে ‘আল-বায়তুল মামুর’ প্রকাশ করা হল, এরপর আমার সামনে (৩টি পাত্র পরিবেশন করা হলো)– একটি শরাবের পাত্র,- একটি দুধের পাত্র ও- একটি মধুর পাত্র রাখ হল।

আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তখন জিবরিল বললেন, এটিই হচ্ছে ফিতরাত। আপনি ও আপনার উম্মতগণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত।

৫০ নামাজকে ৫ ওয়াক্তে সাব্যস্ত করার ঘটনাতারপর আমার উপর দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হল। এরপর আমি ফিরে আসলাম। মুসা আলাইহিস সালাম-এর সম্মুখ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- আল্লাহ তাআলা আপনাকে কী আদেশ করেছেন?রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাকে দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে সমর্থ হবে না। আল্লাহর কসম! আমি আপনার আগে লোকদের পরীক্ষা করেছি এবং বনি ইসরাইলদের হেদায়াতের জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছি। তাই আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের (বোঝা) হালকা করার জন্য আরজ করুন।আমি ফিরে গেলাম। ফলে আমার উপর হতে দশ (ওয়াক্ত) কমানো হলো। আমি আবার মূসা আলাইহিস সালামের কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবার আগের মত বললেন।আমি আবার ফিরে গেলাম। ফলে আল্লাহ তা’আলা আরও দশ (ওয়াক্ত) কমিয়ে দিলেন। ফেরার পথে মূসা আলাইহিস সালামের কাছে পৌঁছলে, তিনি আবার আগের কথা বললেন।আমি আবার ফিরে গেলাম। আল্লাহ তাআলা আরো দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। আমি মূসা আলাইহিস সালামের কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবারও একই কথা বললেন।আমি আবার ফিরে গেলাম। তখন আমাকে প্রতিদিন দশ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আদেশ দেয়া হয়। আমি ফিরে এলাম। মূসা আলাইহিস সালাম ঐ কথাই আগের মত বললেন।আমি আবার ফিরে গেলাম, তখন আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ করা হয়। তারপর মূসা আলাইহিস সালাম কাছে ফিরে এলাম। তিনি বললেন, আপনাকে কী আদেশ দেয়া হয়েছে? আমি বললাম, আমাকে দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছে।মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায় করতেও সামর্থ হবে না। আপনার আগে আমি লোকদের পরীক্ষা করেছি। বনি ইসরাইলদের হেদায়াতের জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছি। আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য আরো সহজ করার আরজি পেশ করুন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি আমার রবের কাছে আরজি করেছি, এতে আমি লজ্জাবোধ করছি। আর আমি এতেই সন্তুষ্ট হয়েছি এবং তা মেনে নিয়েছি।

তারপর তিনি বললেন, আমি যখন (মুসা আলাইহিস সালাম থেকে বিদায় গ্রহণ করে সামনের দিকে) অগ্রসর হলাম, তখন এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিলেন- ‘আমি আমার অবশ্য প্রতিপাল্য নির্দেশ জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের উপর হালকা করে দিলাম।’ (বুখারি)

মেরাজের অন্যান্য ঘটনা হাদিসের আলোকে এটি ছিল বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের সংক্ষিপ্ত চিত্র। এ সফরে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো অনেক কিছু নিজ চোখে দেখেছেন। বিভিন্ন হাদিসে তিনি তা বর্ণনা করেছেন।

” এ রাতে বিশ্বনবি জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে মালেক নামক জাহান্নামের প্রধান রক্ষী নবীজীকে সালাম ও অভ্যর্থনা জানান”। (মুসলিম)

লাইলাতুল মেরাজ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতি বিজড়িত শ্রেষ্ঠ মুজিজা। এ রাতেই আল্লাহ তাআলা ইসলামের প্রধান ইবাদত নামাজকে শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে দান করেছেন। এ কারণেই একনিষ্ঠতার সঙ্গে নামাজ আদায়কে মুমিনের মেরাজ বলা হয়। এ নামাজের মাধ্যমেই বান্দার সঙ্গে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য তৈরি হয়।

পবিত্র লাইলাতুল মেরাজ প্রতি বছরই মানুষকে প্রিয়নবির জীবনের সেরা ঘটনা ও মুজিজার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নামাজ মুমিনের মেরাজ স্বরূপ সেকথাও স্মরণ করিয়ে দেয়।

লাইলাতুল মেরাজ ঈমানদার মুমিন মুসলমানের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের সেরা অনুপ্রেরণা। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আল্লাহ তাআলার একান্ত সাক্ষাতের শিক্ষা মানুষকে নামাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

মানুষ এ পবিত্র রাতের নামাজ, জিকির-আজকার, কুরআন তেলাওয়াতসহ যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগীতে রাত অতিবাহিত করে। মাওলার নৈকট্য লাভে নিজেকে নিয়োজিত রাখে।

এ রাতের বিশেষ কোনো ইবাদত বা এ রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোনো রোজার সুস্পষ্ট বর্ণনা সহিহ হাদিসে না থাকলেও আল্লাহর নৈকট্য লাভে হযরতে ওলামায়েকেরাম সুফি-সাধক বৃন্দ এবং সাধারন মুমিন মুসলমান মেরাজকে উপলক্ষ করে দিনের বেলায় রোজা পালন এবং রাতে ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করে।

ادعية ليلة الاسراء والمعراج

শবে মেরাজের দু’আ

(اللهُمَّ إني أَسْأَلُكَ العافيةَ في الدنيا والآخرةِ، اللهُمَّ إني أَسْأَلُكَ العَفْوَ والعافيةَ في دِينِي ودُنْيَايَ، وأهلي ومالي، اللهُمَّ اسْتُرْ عَوْراتِي وآمِنْ رَوْعاتِي، اللهُمَّ احْفَظْنِي من بينِ يَدَيَّ، ومن خلفي، وعن يميني، وعن شمالي، ومن فوقي، وأعوذ بعَظَمَتِكَ أنْ أُغْتالَ من تحتي)
(يا حيُّ يا قيُّومُ برَحمتِكَ أستَغيثُ أصلِح لي شأني كُلَّهُ ولا تَكِلني إلى نَفسي طرفةَ عينٍ)
(اللهمَّ إنِّي أعوذُ بك من الهمِّ والحزنِ، والعجزِ والكسلِ، والبُخلِ والجُبنِ، وضَلَعِ الدَّينِ، وغَلَبَةِ الرجالِ)
(اللَّهُمَّ لكَ الحَمْدُ أنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ والأرْضِ ومَن فِيهِنَّ، ولَكَ الحَمْدُ لكَ مُلْكُ السَّمَوَاتِ والأرْضِ ومَن فِيهِنَّ، ولَكَ الحَمْدُ أنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ والأرْضِ ومَن فِيهِنَّ، ولَكَ الحَمْدُ أنْتَ مَلِكُ السَّمَوَاتِ والأرْضِ، ولَكَ الحَمْدُ أنْتَ الحَقُّ ووَعْدُكَ الحَقُّ، ولِقَاؤُكَ حَقٌّ، وقَوْلُكَ حَقٌّ، والجَنَّةُ حَقٌّ، والنَّارُ حَقٌّ، والنَّبِيُّونَ حَقٌّ، ومُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ حَقٌّ، والسَّاعَةُ حَقٌّ، اللَّهُمَّ لكَ أسْلَمْتُ، وبِكَ آمَنْتُ، وعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، وإلَيْكَ أنَبْتُ، وبِكَ خَاصَمْتُ، وإلَيْكَ حَاكَمْتُ، فَاغْفِرْ لي ما قَدَّمْتُ وما أخَّرْتُ، وما أسْرَرْتُ وما أعْلَنْتُ، أنْتَ المُقَدِّمُ، وأَنْتَ المُؤَخِّرُ، لا إلَهَ إلَّا أنْتَ – أوْ: لا إلَهَ غَيْرُكَ – قالَ سُفْيَانُ: وزَادَ عبدُ الكَرِيمِ أبو أُمَيَّةَ: ولَا حَوْلَ ولَا قُوَّةَ إلَّا باللَّهِ

উল্লেখ্য, শবে মেরাজের নির্দিষ্ট হাদিসে বর্ণিত কোন দু’আ না থাকলেও এই রজনীতে বিশিষ্ট তাবি’ঈগণ এবং মুহাদ্দিসীনে কেরাম থেকে উপরোক্ত দুআ গুলোর উল্লেখ রয়েছে

তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো রজব মাসের শুরু থেকেই আল্লাহর কাছে বরকতের দোয়া করতেন এবং রমজান পর্যন্ত জীবন লাভে সবসময় ধরণা ধরতেন।

তাই রজব মাসে আল্লাহর কাছে বরকত ও কল্যাণের দায়া করাও প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ এবং সুন্নাত।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র মেরাজকে কেন্দ্র করে একনিষ্ঠ নামাজি হিসেবে কবুল করুন। মুমিনের প্রতি ওয়াক্ত নামাজকে মেরাজ হিসেবে গণ্য করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ :