শ্রীনগর প্রতিনিধি : ছিলেন টিউবওয়েল মিস্ত্রি।বাড়ি বাড়ি নলকূপ স্থাপন করে চলত তার জীবন-জীবিকা।হঠাৎ করেই পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ!আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠে তার।রাতারাতি গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়।আর এসব করতে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন সাজানো মামলা।হয়রানি করে সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে দেন।মামলাবাজ হিসেবে বিশেষভাবে কুখ্যাতি পাওয়া এই ব্যক্তির নাম আলেপ বেপারি।বসবাস ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জে।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বালাসুর গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আলেপ বেপারি।জবরদখল ওয়ারিশ ও অংশীদার ঠকানোই যেন তার পেশা।মৃত ছমির উদ্দিন বেপারির পুত্র আলেপ বেপারি চাঁদাবাজি ও মিথ্যা মামলা দিতে নান্নু মুন্সি ও ছানি মুন্সিকে নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন।তবে এর আগে তার বাহিনীতে আরও অনেক সক্রিয় সদস্য থাকলেও পরে তারা অনেকেই তার থেকে সরে গেছেন।তবে বর্তমানে নান্নু মুন্সী ও ছানি মুন্সী ছাড়াও বিকল্প যুব ধারার কেন্দ্রীয় এক নেতা তার বাহিনীতে সক্রিয় ভূমিকায় থেকে আলেপ বেপারীর অবৈধভাবে দখল করা জমির দেখভাল ও ওই সকল জমির ভূয়া কাগজ তৈরি করে তা বিক্রি করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এই চক্রটি দীর্ঘদিন যাবৎ সাজানো মামলা দিয়ে জেল খাটিয়ে এলাকার হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছে।তাদের রোষানলে পড়ে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই।মিথ্যা মামলায় হয়রানির ভয়ে এলাকাবাসী চরম আতঙ্কিত।সম্মান হারানোর ভয়ে কেউ কেউ আবার এ চক্রের সঙ্গে আপস করে নিচ্ছেন।মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির বিষয়টি এলাকায় ওপেন সিক্রেট।তবুও চক্রটি অদৃশ্য কারণে থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিভিন্ন ব্যক্তির নামে দায়ের হওয়া অনেক মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট ১০-১২ জনের একটি চক্রই ঘুরে ফিরে মামলার বাদী আর সাক্ষী হচ্ছেন।এদের মধ্যে থেকেই একজনকে বাদী করে অন্যদের মামলায় সাক্ষী বানানো হচ্ছে।
জানা গেছে, টিউবওয়েল মিস্ত্রি থাকাকালে বালাশুর এলাকার সাহেব বাবুর দান করে জাওয়া সম্পত্তি ও বাড়ির দখলে থাকা মৃত বাবর আলী সরদার নামের এক ব্যক্তিকে তার পরিবারের সকল সদস্য সহ জোর পূর্বক মারধর করে ও ঘরে আগুন দিয়ে বাড়িঘর ছাড়া করেন আলেপ বেপারী।পরে বাবর আলী সরদার ও তার ৩ ছেলে সন্তানের নামে মিথ্যা মামলাও দায়ের করেন।মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে নিরুপায় হয়ে বাবর আলী সরদার তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে অন্যত্র চলে যান।এর আগে আলেপ বেপারী প্রতারণা ও জবরদখল করতে বাবর আলী সরদারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের নানান কৌশলও অবলম্বন করেন।যা বালাশুর ও এর আসপাশের এলাকার বেশিরভাগ মানুষেরই জানা।
রাঢ়ীখাল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ বেপারী বলেন, সাহেব বাবুর বাড়িতে বাবর আলী সরদার ও খলিল খোড়া নামের দুই ব্যক্তি তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।আলেপ বেপারী তাদের ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে, মারধর করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের জায়গা জবরদখল করে উচ্ছেদ করেছে যা এ অঞ্চলের মানুষের অনেকেরই জানা।তাদের সাথে কাজটা খুব অন্যায় করা হয়েছে।
অপরদিকে শ্রীনগর এলাকায় প্রায় আট একর জমি অংশীদারিত্বে ক্রয় করার কথা বলে আলেপ বেপারি কিছু পরিচিত লোকের কাছ থেকে টাকা নেন।জমি কেনা হলেও পরবর্তীতে অংশীদারদের না দিয়ে জমি নিজের নামেই রেজিস্ট্রি করেন।অন্যদিকে, অংশীদারদের টাকা ফেরত না দেয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেন।সাজানো মামলায় সাধারণ মানুষকে হয়রানির এমন অভিজ্ঞতাকে আলেপ বেপারি বার বার কাজে লাগাতে শুরু করেন।
বিত্তবান ও জমির মালিকদের টার্গেট করে পাতেন ফাঁদ।সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে- মিথ্যা মামলাই যেন তার মূল অস্ত্র।বিভিন্ন অজুহাতে আলেপ বেপারির মামলা করার নেশা পেয়ে বসে।আর এর মাধ্যমে একের পর এক ঘায়েল করতে থাকেন মানুষের সম্পত্তি।আর এই কাজের জন্য গড়ে তোলেন দলিল ও ওয়ারিশ সার্টিফিকেট জালিয়াতিসহ একটি জালিয়াত সিন্ডিকেট।
এদিকে, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে একই এলাকার সিরাজ মীরকে পুড়িয়ে হত্যা করে এ চক্র।মৃত্যুর আগে সিরাজ মীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আলেপ বেপারি ও তার সহযোগীদের নাম উল্লেখ করে জবানবন্দি দিয়ে জান।পরে সিরাজ মীরের মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়ে এলাকাবাসী ও তার স্বজনরা আলেপ বেপারী ও তার সহযোগীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল পোষ্টার ও হাতে লেখা ব্যানার টানিয়ে প্রতিবাদ জানান।বেশ কিছু দিন প্রতিবাদ চললেও বর্তমানে অন্ধকারেই ডুবে আছে সিরাজ হত্যা কান্ডের বিচার প্রক্রিয়া।
শ্রীনগরের বালাশুর গ্রামের বাসিন্দা মো. জুলহাস বেপারি বলেন, আলেপ বেপারিদের দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় আমার ভাই, শ্বশুর, শ্যালক, মামাতো ও খালাতো ভাইসহ মোট ১৬ জনের নামে ২০১৪ সালে মিথ্যা মামলা দেয়।মামলা নং- সি. আর ২৪২ / ২০১৪। এই মামলায় চার বছর আদালতে হাজিরা দিতে দিতে এক পর্যায়ে হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়েই আলেপ বেপারিকে তাদের দাবিকৃত চাঁদার টাকা পরিশোধ করে মামলা আপস করি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলেপ বেপারির রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি হয় জাতীয় পার্টির আমলে মরহুম শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের পৃষ্ঠপোষকতায়। পরবর্তীতে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে কৌশলে ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছাত্রদলের এক প্রভাবশালী ছাত্রনেতার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেন আরও বেশী শক্তিশালী।আর সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং মামলাবাজিকে পুঁজি করে রাতারাতি সম্পদের মালিক হয়ে যান।এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।আইন আদালতের ফাঁকফোকর আর টাকার জোরে তিনি এখন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। এই আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি এখন একের পর এক তার অভীষ্ট লক্ষ্য জয় করে চলেছেন।
আলেপ বেপারির আপন ভাতিজা মো. মোয়াজ্জেম বলেন, আলেপ বেপারির রোষানলে আর সাজানো মামলায় পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি।বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় এখন তাকে কিছু বলাও যাচ্ছে না।তবে এলাকাবাসী তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলেপ বেপারির এক ভাগিনা বলেন, আলেপ বেপারি আমার আপন মামা। আর আমার মা খালারা ৩ বোন।কিন্তু আলেপ বেপারি জাল ওয়ারিশ সার্টিফিকেট তৈরি করে তা দিয়ে আমার নানার সব সম্পত্তি একার নামেই নামজারি করিয়েছেন।এর বিরুদ্ধে আসল ওয়ারিশ সার্টিফিকেট তুলে আমরা আদালতের স্মরণাপন্ন হলে তিনি আরও ক্ষুব্ধ হয়ে আমার নামে ও আমার খালাতো ভাইদের নামে চাঁদাবাজির মামলা দেন।
অভিযোগ রয়েছে, আলেপ ব্যাপারির এই গ্যাং তাদের টার্গেটকৃত ব্যক্তির কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন।চাঁদা দিতে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে হেনস্থা করতে চক্রের সদস্যদের বাদী করে সাজানো মামলা দায়ের করেন।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জ কোর্টে গত ৩০ বছরে দুই শতাধিক মামলার বাদী আলেপ বেপারি ও তার বাহিনীর সদস্যরা।তার বিবাদীর সংখ্যা হাজার হাজার।সম্পদশালী সংখ্যালঘু পরিবারগুলো এলাকা ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।তার সহযোগী নান্নু মুন্সী এবং নান্নুর ছেলে ছানি মুন্সী তার সব মামলার সাক্ষী।বালাশুর অঞ্চলে কোনো না কোনো মামলায় আসামি হয়নি এমন প্রাপ্তবয়স্ক লোক পাওয়া দুষ্কর।তার মামলার ধরনগুলোও বৈচিত্র্যময়।আইন আদালতে দীর্ঘদিন যাতায়াতের ফলে তিনি অনেক বিজ্ঞ আইনজীবীর চেয়েও বেশি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন।অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে তিনি অনেক সময় আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।নিজের ঘর আগুনে পুড়িয়ে, নিজের মানুষকে মেরেও তিনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মামলা করেছেন।সাজানো মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জিম্মি করে মানুষের ভিটামাটি দখল করে এবং এরপর মামলা নিষ্পত্তিবাবদ মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন এ বাহিনী।ঢাকার বনশ্রীতে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। গ্রামের বাড়িতে করেছেন অট্টালিকা।পরিবারের সদস্যদের বিদেশে আয়েশি জীবন নিশ্চিত করেছেন।
এ ব্যাপারে শ্রীনগরের বালাশুর গ্রামের প্রবাসী তাছের বেপারি জানান, আমি ইতালি থেকে ২০১২ সালে যখন দেশে আসি তখন আলেপ বেপারি ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে নান্নু মুন্সিকে আমার কাছে পাঠায়।আমি চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ক্ষুব্ধ হয়ে নান্নু মুন্সিকে বাদী করে আমিসহ আমার ঘনিষ্ঠ পাঁচজনকে আসামি করে একটি মিথ্যা মামলা করে।পরবর্তীতে হয়রানি এড়াতে আলেপ বেপারিকে চাঁদার টাকা দিয়ে মামলায় আপস করে ফেলি।কিন্তু দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি আবারও পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে।আমি অপারগতা জানালে এবার ছানি মুন্সীকে বাদী করে ঢাকার আদালতে আমার ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত ১১ জনকে আসামি করে একটি চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করে।যার মামলা নম্বর পিটিসন-১৩/২০২১।
জানা গেছে, এলাকাবাসী বেশ কয়েকবার অতিষ্ঠ জনগণের গণধোলাইয়ের শিকার হতে হয়েছে আলেপ বেপারিদের।বালাশুরের জামাইপাড়ায় একবার অতিষ্ঠ মহিলারা ঝাডুপেটা করেন।হত্যা মামলায় অনেক দিন জেল খেটেছেন।কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে বেরিয়ে আসেন।
গ্রামবাসীর অভিযোগে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাকে পিটিয়ে শ্রীনগর ব্রিজের ওপর ফেলে রেখে যায়।দুর্নীতি দমন কমিশনে রয়েছে দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সব অভিযোগ মিথ্যা ভিত্তিহীন বলে জানান আলেপ বেপারি।বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।আমি অসুস্থ মানুষ, এটুকু বলেই তিনি লাইন কেটে দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীনগর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, আলেপ বেপারি সম্পর্কে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply