ফারুক আহমেদ :
ডিসেম্বর মাস ! হু হু করে শীতের বাতাস বইছে ! আজ সন্ধ্যে থেকে পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ নেই । গভীর রাত ! হটাৎ করে রহমান পোদ্দারের ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ শুনে বাড়ির সবাই উঠানে এসে হাজির হলো । সবার একই প্রশ্ন কি হলো, কি হলো ? বড়ো ভাই কেন এমন করে চিৎকার করে কান্না করছে ? বাড়ির সবাই এসে রহমান পোদ্দারের দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল…..!
দেশে স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে ! সারা দেশেই মানুষ স্বস্তির নিঃশাস ফেলছে । যারা এতো বছর নির্যাতিত হয়েছিল, স্বৈরশাসনের পতনের পর তারাও আল্লার নিকট শুকরিয়া আদায় করছে । যারা সমাজে এতদিন অনাচার, অত্যাচার, দুর্নীতি করত, মাদক ব্যবসা জমজমাট ভাবে চালাত তাদের অনেকেই গ্রাম ছাড়া হয়েছে! যারা দুর্নীতিবাজদের দোসর ও চামচা ছিল তারাও অনেকটা গা ঢাকা দিয়ে আছে !
গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা এতো দিন নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়েছিল, তারা সবাই সমাজে একতাবদ্ধ হয়েছে । সবাই মিলে গ্রামে “ওয়েলফেয়ার সোসাইটি” তৈরি করেছে ! তাদের উদ্দেশ্য গ্রামের শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা । গত শুক্রবার তারা সবাইকে ডেকে, এক সাথে হয়ে বিশেষ মিটিং করেছে এবং সবাই হাতে হাত রেখে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছে যে, “তারা প্রয়োজনে রক্ত দিবে, কিন্তু নিজের জন্মভূমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে ! পতিত স্বৈরশাসনের পতনের পর, গ্রামে আর কাউকেই স্বৈরাচারী ও দুর্নীতি করতে দিবে না।”
গ্রামের “ওয়েলফেয়ার সোসাইটির” এই একতা দেখে, স্বৈরাচারের পতনের পর নুতন করে যারা গ্রামে মাথা চারা দিয়ে উঠার স্বপ্ন দেখেছিল, তারা চুপসি খেয়ে গেছে !
ইতি মধ্যেই “ওয়েলফেয়ার সোসাইটির” পক্ষ থেকে দেশের শিক্ষিত, প্রফেশনাল, বিজ্ঞ এবং ভালো মানুষদের আহব্বান করছে তাদের সাথে সহযোগিতা করার জন্য । এক সাথে হাতে হাত রেখে তাদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য । গ্রামের মানুষও নুতন প্রজন্মের এই সৈনিকদের আগ্রহ দেখে এগিয়ে আসছে এবং তাদের হাতকে শক্তিশালী করছে । এ যেন গ্রামকে রক্ষা নয়, এ যেন নিজের জন্মভূমি, নিজের “মাকে” রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা !
“ওয়েলফেয়ার সোসাইটির” সবাই মিলে আগামী ২৫-৫০ বছর পর এই গ্রামকে কিভাবে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে তৈরি করা যায়, সেই আদলে বিজ্ঞ ও প্রফেশনাল টীম দিয়ে একটি পরিপূর্ণ “সংবিধান / নীতিমালা” তৈরি করেছে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো —- আগামী ২৫-৫০ বছর পর গ্রামের মানুষ হবে ১০০% শিক্ষিত। যেখানে থাকবে না কোন গরিব মানুষ, গ্রামের সবাই হবে কর্মজীবী, গ্রামের তৈরি হবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, বিচারক সহ নানা পেশার মানুষ । থাকবে না গ্রামে কোন অনাচার, অত্যাচার, থাকবে না কোন মাদক সেবক বা বিক্রেতা । গ্রাম হবে একটি শান্তির পূর্ণ আদর্শ গ্রাম ।
গত শুক্রবার গ্রামে নুতন করে পঞ্চায়েত কমিটি, মসজিদ ও কবরস্থান কমিটি এবং স্কুল কমিটি তৈরি হয়েছে । নতুন কমিটি তৈরি করা হয়েছে সম্পূর্ণ নুতন ভাবে, সেই কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে গ্রামের কেবল মাত্র ভালো মানুষগুলোকে নিয়। যেখানে দুর্নীতির ব্যাপারে কোন ছাড় দেওয়া হয়নি । সেই কমিটিতে সামান্যতম দুর্নীতি বা সন্ত্রাসী কাউকে রাখা হয়নি । সেখানে বাদ পড়েছে গ্রামের এক সময়কার দুর্নীতিবাজ বড়ো মাতব্বর রহমান পোদ্দার এবং তার বড়ো সহযোগী হোসেন আলী সহ বাকি ওর সব সহযোগীরা ।
আজ রহমান পোদ্দার ও তার সহযোগী হোসেন আলী, তারা কেউ মসজিদে জুম্মা নামাজ পড়তে যায় নি । রহমান পোদ্দার পতিত স্বৈরাচারী সরকারের বদৌলতে সে ছিল গ্রামের বড়ো মাতব্বর । তার বড়ো সহযোগী ছিল হোসেন আলী সহ আরও অনেকে । গ্রামের নুতন কমিটিতে সবাই তাদের “বয়কট” করেছে । নুতন কমিটিতে তাকে ও তার চামচাদের এই ভাবে “বয়কট” করাতে রহমান পোদ্দার ও তার সহযোগী হোসেন আলী সহ বাকি সবাই ভীষণ লজ্জায় পরে গেছে ! তারা অনেক মনোক্ষুন্ন হলেও আজ কিছুই বলার সাহস তাদের নেই !
রহমান পোদ্দারের বউ, মর্জিনা বেগম আজ দুপুরের খাবার দিয়ে ডাইনিং টেবিল সাজিয়েছে, স্বামী রহমান পোদ্দার ও তার দল বল এক সাথে খাবে বলে । যা সে করে যাচ্ছে প্রতি শক্রবার, দীর্ঘ বছর ধরে । প্রতি শুক্রবার এই খাবারের টেবিলেই দুপুরের লাঞ্চ শেষ করে চলে রহমান পোদারের দল বল নিয়ে মিটি। সেখানেই চলে টাকা পয়সার লেন দেন এবং কোন বিচারে কি রায় দিতে হবে তা এই মিটিং এ ফায়সালা হয় !
আজ খাবার সাজিয়ে বার বার ডাকার পরও স্বামীকে খাবার টেবিলে না দেখে রহমান পোদারের বউ, মর্জিনা বেগম নিজেই ড্রয়িং রুমে এসে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল,
মর্জিনা বেগম: আফনার আজ কি অইছে, খাবার খেতে আইতাছেন না কেন ?
রহমান পোদ্দার: কি খাবার খামু , আমার মান সম্মান সব শেষ হয়ে গেছে….. ! গ্রামে আর কোন ইজ্জত রইল না !
মর্জিনা বেগম: কি হইছে খুইল্লা কন, ইজ্জদ নষ্ট অইল কেমনে ?
রহমান পোদ্দার: গ্রামের সব মানুষ আমারে “বয়কট” করছে । গ্রামে নুতন পঞ্চায়েত কমিটি হইছে, আর সব কমিটি থেইক্যা আমারে বাদ দিছে ।
মর্জিনা বেগম: আফনে যা করছেন এটাই তার ফল । গ্রামের মানুষ উচিত বিচার করছে । আফনে তো কম দুর্নীতি করেন নাই । গ্রামের সব বিচার টাকা খাইয়া করছেন ! আফনার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়া কত মানুষের ঠেঙ্গাইছেন, কত মানুষের জায়গা জমি অন্যায় ভাবে দখল করছেন, আফনার নেতৃত্বে গ্রামে জুয়া – মদ – গাজা ব্যবসা চলছে । আফনেরে কত বুঝাইছি এইসব ছাইড়া দেন, বালা অইয়া জান, আফনি হোনেন নাই । অহন মজাডা বুজেন ! আমি আফনার লগে নাই ।
রহমান পোদ্দারের বউ এর কথাগুলো তার চামচা হোসেন আলী শোনালেও কোন কথা বলেন নি । সে এতক্ষন মাথা নিচু করে বসেছিল । কিছুক্ষন পর মাথা উঠিয়ে হোসেন আলী বলতে লাগল,
হোসেন আলী: ভাইজান আসলে আমাদের এত বেশি অত্যাচার করা ঠিক হয় নাই ।
রহমান পোদ্দার: অহন কেন এসব বলছ, আগে তো টাকার ভাগ পাইয়া চুপ ছিলা । বুঝছি অহন আমার সময় খারাপ, তাই উল্টা পাল্টা কইতাছস ।
হোসেন আলী: না ভাইজান আপনি মাইন্ড কইরেন না ।
একটু পরই রহমান পোদ্দারের বউ মর্জিনা বেগম আবার এসে বললো, “খাবারের টেবিলে আহেন খাবার সব ঠান্ডা হইয়া গেল ।” যাওয়ার আগে সে আরও বলতে লাগল,
মর্জিনা বেগম: মনে রাইখেন আপনার এই অপকর্মের জন্য, আপনার এই দুর্নামের জন্য যদি ফুলতলা গ্রামের রহিম মাস্টারের সাথে আমার মাইয়া “তুলির” বিয়া ভাইঙ্গা যায়, তাইলে আমি কিন্তু আপনারে ছাড়ব না । অনেক কষ্ট কইরা মাইয়া পালছি ।”
বউয়ের এমন হুমকি স্বরূপ কথা শুনে রহমান পোদারের আজ পিলা কেঁপে উঠল! তার বুক ধড়পড় করতে লাগলো! তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগল ! তার শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল !
এই ভাবেই আজ রহমান পোদ্দারের সারাদিন খুব দুঃশ্চিন্তা ও মন খারাপের মধ্যে দিন কাটল ! সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত যখন গভীর হলো, তখন সে জানতে পারলো । আসে পাশের ১০ গ্রামের মানুষ পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সব সহযোগীদের ও তাদের চামচাদের “বয়কট” করেছে!
একই সাথে ঘটক ফটিক মিয়া জানালো ফুলতলা গ্রামের মজিদ মাস্টারের সাথে তার মেয়ে তুলির বিয়ে প্রস্তাব ভেঙ্গে গেছে ! এই দুঃসংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে রহমান পোদ্দার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সেই চিৎকারে মনে হয় আকাশ পাতাল ভেঙ্গে পড়ছে! তার কান্না দেখে বাড়ির সব মানুষ বাড়ির উঠানে এসে হাজির হলো !
অন্য দিকে আজ সন্ধ্যা থেকে মেয়ে “তুলি বেগমকে” খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ! চতুর দিকে খবর লাগিয়েছে মেয়ে কোথায় গেল, কার সাথে গেল! এসব কি হচ্ছে ? রহমান পোদ্দার আজ কিছুই মিলাতে পারছে না !
এসব দেখে রহমান পদারের বউ মর্জিনা বেগম বলতে লাগলো,
“এই গুলি হলো সব আল্লাহর গজব ! আফনে এত বছর মানুষের সাথে এত দুর্নীতি, অন্যায় অত্যাচার ও অবিচার করছেন এই গুলি তার ফল! আল্লাহ ছাড় দেয়, কিন্তু কাউকেই ছেড়ে দেয় না । যদি আমার মেয়েকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আইনা না দেন, আমি আফনার লগে থাকমু না” বলেই মর্জিনা বেগম কাঁদতে লাগল !
একই সাথে রহমান পোদারের বউ, মর্জিনা বেগম হোসেন আলীকে বলতে লাগল,
“আফনেও পোদ্দার সাহেবের শক্তি দেহাইয়া গ্রামের মানুষের সাথে অনেক অন্যায় করছেন ! আফনে আপনার ভাই বোনদের সম্পত্তি নিয়ে অনেক ছিনি মিনি খেলছেন ! মাইনসে কয় আফনের সমস্ত সম্পত্তি অবৈধ ! আপনি নাকি একটা সম্পত্তিও নিজের টাকা দিয়া কিনেক নাই, সবটাই নাকি বাটপারি কইরা নিছেন ! এমনকি আফনি আপনার বড়ো বোনকে ব্ল্যাক মেইল কইরা তার বাড়ি দখল করছেন, সেই দুঃখে বড়ো বোন হার্ড ফীল কইরা মইরা গেছে ! টাকা পয়সা দিয়া কি অইব? কবরে নিয়ে যাইতে পারবেন ? এই অন্যায়ের বিচার আল্লাহ করব, অপেক্ষা করেন”!
বউ মর্জিনা বেগমের এসব কথা সোনার পর রহমান পোদ্দার হাউ মাও করে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল,
“আমি সারা জীবন অনেক অন্যায় করেছি, তোমরা আমারে ক্ষমা করে দিও ! আমি এত দিন যার কাছ থেকে যত টাকা নিয়াছি, যার জায়গা সম্পত্তি অন্যায় ভাবে নিয়াছি আমি সব ফেরত দিয়া দিব!”
রহমান পদারের কান্না দেখে, চামচ হোসাইন আলীর চোখেও পানি আসে গেল এবং সেও মনে মনে ভাবতে লাগল,
“আমিও সারা জীবন অনেক অন্যায় করেছি ! ভাই বোনদের অনেক ঠকিয়েছি, যে ছোটভাই সাগর আহম্মেদ এর সহযোগিতায় আজ আমি এতদূর এগিয়েছি, সেই ভাইয়ের কেবল সম্পত্তিই আত্মসাৎ করিনি, তার গায়ে আমি হাতও উঠিয়েছি ! আল্লাহ আমাকে সত্যি কোনোদিন ও ক্ষমা করবেন না ! এসব ভাবতে গিয়ে হোসেন আলীর চোখেও পানি এসে গেল ”!
এরই মাঝে, হটাৎ করেই রহমান পোদ্দার সেন্সলেস হয়ে মাটিতে পরে গেল! পাড়ার মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ আসতে লাগল ! বাড়ির সবাই ফোন করে সদরের হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে লাগল! কেউ কেউ হোন্ডা নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল বাড়িতে ডাক্তার আনার জন্য !