স্টাফ রিপোর্টারঃ
মুন্সীগঞ্জ জেলার গর্বিত সাংবাদিক, প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ভাষাসৈনিক, চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদ-এর ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর)।
সফিউদ্দিন আহমেদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাড়িদিয়া গ্রামে। তার বাবা জলকদর দেওয়ান বার্মিজ জাহাজের সারেং ছিলেন।
সফিউদ্দিন আহমেদ স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই সাংবাদিকতা শুরু করেন। জড়িত ছিলেন ছাত্র রাজনীতির সাথেও। চলি্লশের দশকে তিনি অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেসে যোগ দেন।
১৯৪৮ সালে সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় বাংলা মাতৃভাষার জন্য রাজপথে আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন সফিউদ্দিন আহমেদ। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দী থাকাবস্থায় গুলি বর্ষণ করা হলে বুদ্ধি বলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকার জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় সফিউদ্দিন আহমেদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং কারাবরণ করেন। যার ফলে তিনি ‘ভাষা সৈনিক’ উপাধি অর্জন করেন।
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে সম্পৃক্তির অভিযোগে অন্যান্য দেশবরেণ্য নেতাদের সঙ্গে সফিউদ্দিনকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
বরেণ্য সাংবাদিক সফিউদ্দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি মুন্সিগঞ্জ প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি এখনো জেলার সর্ব পুরোনো সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত ২৬ জাতি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সাংবাদিকদের কনফারেন্সে সফিউদ্দিন বাংলদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের প্রতিযোগিতা অংশে, সিরিজ বক্তৃতায় বাংলাদেশের গ্রামীণ সাংবাদিকতার ওপর বক্তব্য রেখে তিনি প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
বাংলাদেশের বিখ্যাত চারণ সাংবাদিক এবং বিক্রমপুরের কৃতিসন্তান হিসেবে ২০০০ সালে ভারতের কলকাতায় বিক্রমপুর সম্মেলনের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
সাংবাদিকতায় অবদান রাখার জন্য জনকণ্ঠ “প্রতিভা সন্মাননা ১৯৯৯”, “মাওলানা মনিরুজ্জামান ( চট্টগ্রাম) স্বর্ণপদক ২০০২”, “বাংলাদেশ সুফি পরিষদ পদক ২০০৬” মাওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পদক, অতীশ দিপংকর পদক সহ আরও বহু গুণীজন সম্মাননায় ভূষিত হন চারণ এই সাংবাদিক।
সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ২০০৬ সালে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বন্দি থাকা রাজবন্দী সফিউদ্দিন আহমদকে সম্মাননা ও পদক প্রদানসহ জায়নামাজ ও তসবি উপহার দেন।
পাকিস্তান রাজত্বকালে সাধারণ মানুষের দুর্দশা ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্যে তিনি বেশ কয়েকবার জেল খাটেন দেশের বিভিন্ন জেলার কারাগারে। জেলে থাকাকালীন অবস্থায় কয়েকবার তাঁর ওপর নির্দয় অত্যাচার ও নিপীড়ন-ও হয়।
সফিউদ্দিন গ্রাম ও মফস্বলের সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন, সম্মান ও বিবিধ সুযোগ সুবিধার জন্যে আজীবন লড়ে গিয়েছেন। অকুতোভয় সফিউদ্দিন আহমেদ প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে এইসব দাবিদাওয়া নিয়ে দিনের পর দিন যুদ্ধ করেছেন।
১৯৪৩ সালে সাপ্তাহিক জনযুদ্ধ নামক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন তিনি। দেশের নামকরা সব জাতীয় দৈনিকে, যেমন- আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, ইত্তেহাদ, মিল্লাত, আমার দেশ, বাংলাদেশ অবজার্ভার, মর্নিং নিউজ ইত্যাদি কাগজে তিনি কাজ করেছেন। তিনি মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বিক্রমপুর বার্তা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
‘দৈনিক বাংলা’ সর্বশেষ বন্ধ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই সাংবাদিকতা করতেন তিনি। সফিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ মফঃস্বল সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এই সংস্থায় ৭ বার প্রেসিডেন্ট ও তিনবার জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।
তার সম্মানার্থে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাবের মিলনায়তন কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে ‘সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদ মিলনায়তন’।
মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর রাতে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
আজীবন সংগ্রামী, আপোষহীন ছাত্রনেতা, ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমদ তার ত্যাগ ও আদর্শের জন্য অমর হয়ে আছেন বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকদের হৃদয়ে।