ফাজালহাক ফারুকির স্লোয়ার বলে জফ্রা আর্চারের বড় শট খেলার চেষ্টায় টাইমিং হলো না ঠিকমতো, ক্যাচ নিলেন মোহাম্মদ নাবি। ইংল্যান্ডের নিভু নিভু সম্ভাবনার প্রদীপটাও যেন নিভে গেল সেখানেই। শেষ ওভারে তারা পারল না নাটকীয় কিছু করে দেখাতে। স্নায়ুর চাপ সামলে আজমাতউল্লাহ ওমারজাইয়ের দারুণ বোলিংয়ে আরেকটি স্মরণীয় জয় পেল আফগানিস্তান। ইংল্যান্ডকে বিদায় করে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখল তারা।
নকআউটে পরিণত হওয়া ‘বি’ গ্রুপের ম্যাচে লাহোরে বুধবার আফগানদের জয় ৮ রানে।
প্রথম পাওয়ার প্লেতে ৩ উইকেট হারানোর পরও ইব্রাহিম জাদরানের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির রেকর্ড ১৭৭ রানের ইনিংসে আফগানিস্তান করে ৩২৫ রান। জবাবে জো রুটের দারুণ সেঞ্চুরির পরও এক বল বাকি থাকতে ৩১৭ রানে গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড।
ইংলিশদের বিপক্ষে আফগানিস্তানের টানা দ্বিতীয় জয় এটি। দুই দলের আগের দেখায় ২০২৩ বিশ্বকাপে দিল্লিতে ৬৯ রানের অবিস্মরণীয় জয় পেয়েছিল তারা। এই সংস্করণে দুই দলের চারবারের দেখায় প্রথম দুটিতে ইংল্যান্ডের জয়ের পর দুটি জিতল আফগানরা।
পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে, স্কিল ও টেম্পারমেন্টের অসাধারণ প্রদর্শনীতে ১৪৬ বলে ১৭৭ রানের ইনিংস খেলেন ইব্রাহিম। ১২ চার ও ৬ ছক্কায় গড়া এই ইনিংসে ম্যাচের সেরাও এই ওপেনার। পুরস্কারটি ওমারজাই পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। ২০২৪ সালে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে ক্রিকেটারের পুরস্কার জেতা এই পেস বোলিং অলরাউন্ডার প্রথমে ছয়ে নেমে ৩ ছক্কা ও এক চারে ৩১ বলে করেন ৪১ রান। পরে দারুণ বোলিংয়ে নেন ৫ উইকেট।
আফগানিস্তানের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে পঞ্চাশ ওভারের আইসিসি টুর্নামেন্টে পাঁচ উইকেট শিকারের কীর্তি গড়লেন ২৪ বছর বয়সী ওমারজাই।
শেষ পাঁচ ওভারে ৪ উইকেট হাতে রেখে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৪৮ রান। সেঞ্চুরি করে উইকেটে তখনও রুট। ম্যাচ অনেকটা হেলে তখন ইংলিশদের দিকেই।
তবে ওমারজাইয়ের দুই ওভারে পাল্টে যায় চিত্র। ৪৬তম ওভারে শেষ স্পেলে বোলিংয়ে ফিরে রুটকে বিদায় করে বড় বাধা দূর করেন তিনি। নিজের পরের ওভারে এসে বিদায় করেন আরেক বাধা হয়ে থাকা জেমি ওভারটনকে। শেষ ওভারে আদিল রাশিদকে ফিরিয়ে ম্যাচের ইতিও টেনে দেন তিনিই।
শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের ১৩ রানের প্রয়োজনে ওমারজাই দেন কেবল ৪ রান।
কাজে এলো না রুটের ১১ চার ও এক ছক্কায় গড়া ১১১ বলে ১২০ রানের চমৎকার ইনিংস। ওয়ানডেতে ৩৭ ইনিংসের মধ্যে তার প্রথম ও ক্যারিয়ারের ১৭তম সেঞ্চুরি এটি। এই ম্যাচের আগে সবশেষ সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি ২০১৯ বিশ্বকাপে।
আসরে প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৫১ রান করেও হারের পর এবারের এই পরাজয়। ২০০৯ সালের পর এই প্রথম ওয়ানডেতে টানা ছয় ম্যাচে হারের তেতো স্বাদ পেল ২০১৯ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলটি।
বিশ্বকাপের পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি; আইসিসির টানা দুটি পঞ্চাশ ওভারের টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ের বিষাদ সঙ্গী হলো তাদের।
এই ম্যাচ নিয়ে আলোচনা চলছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শুরুর অনেক আগে থেকে। আফগানিস্তানে নারীদের শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া, নারীদের ক্রিকেটসহ যাবতীয় খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি বর্জন করতে ইংল্যান্ডের বোর্ডকে অনুরোধ করেছিলেন এক দল ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। তবে নানা বাস্তবতা মাথায় রেখে শেষ পর্যন্ত কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়নি ক্রিকেটাররা ও ইসিবি।
সেই ম্যাচই হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় ঘণ্টা বাজল বাটলার-রুটদের।
বড় লক্ষ্য তাড়ায় ইংল্যান্ডের শুরুটা হয় বাজে। চতুর্থ ওভারে ওমারজাইয়ের বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন ফিল সল্ট। তিনে নেমে আবারও ব্যর্থ হন জেমি স্মিথ। তাকে ফিরিয়ে ওয়ানডেতে টানা তৃতীয় ম্যাচে বোলিংয়ে এসে প্রথম বলে উইকেটের স্বাদ পান নাবি।
সপ্তম ওভারে ৩০ রানে ২ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় ইংল্যান্ড। সেখানে থেকে ৬৮ রানের জুটিতে দলকে টেনে তোলেন রুট ও বেন ডাকেট। প্রথম ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান ডাকেট এবার ফেরেন ৪৫ বলে ৩৮ রান করে। রাশিদ খানের বলে রিভিউ নিয়ে তাকে ফেরায় আফগানরা।
এ দিন ৪ রানে পৌঁছেই ওয়ানডেতে এক হাজার রান পূর্ণ করেন ডাকেট। ২১ ইনিংসে মাইলফলকটি ছুঁলেন তিনি, ইংল্যান্ডের হয়ে যা কেভিন পিটারসেনের সঙ্গে যৌথভাবে দ্রুততম। বিশ্বে যৌথভাবে চতুর্থ দ্রুততম।
ইংল্যান্ডকে লড়াইয়ে রাখেন রুট ও জস বাটলার। পঞ্চম উইকেটে ৯১ বলে ৮৩ রানের ইনিংস সেরা জুটি গড়েন তারা। শর্ট বলে বাটলারকে (৪২ বলে ৩৮) ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন ওমারজাই।
লিয়াম লিভিংস্টোনকে টিকতে দেননি গুলবাদিন নাইব। আশা বাঁচিয়ে রেখে দলকে এগিয়ে নিচ্ছিল রুট ও ওভারটনের জুটি। কিন্তু ৫৪ রানের এই জুটি ভাঙার পরই ধীরে ধীরে লড়াই থেকে দূরে সরে যায় ইংল্যান্ড। হারে আসর শুরুর পর দারুণ জয় সঙ্গী করে মাঠ ছাড়েন রাশিদ-নাবিরা।
আফগানিস্তানের জন্য ম্যাচের শুরুটা ছিল অবশ্য দুঃস্বপ্নের মতো। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে পঞ্চম ওভারে আর্চারের পাঁচ বলের মধ্যে রাহমানউল্লাহ গুরবাজ ও সেদিকউল্লাহ আটালকে হারায় তারা।
নবম ওভারে আর্চারের তৃতীয় শিকার হয়ে রেহমাত শাহ বিদায় নেন যখন, ৩৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তখন ভীষণ চাপে আফগানিস্তান।
পরিস্থিতি বুঝে হাশমাতউল্লাহ শাহিদিকে নিয়ে ইনিংস মেরামতে মনোযোগ দেন ইব্রাহিম। আফগানিস্তানের শতরান পূর্ণ হয় ২৫তম ওভারে, ইব্রাহিম ফিফটি পূর্ণ করেন ৬৫ বলে।
শাহিদির বিদায়ে ভাঙে ১২৪ বলে ১০৩ রানের জুটি। ৬৭ বলে ৪০ রান করেন আফগান অধিনায়ক।
আফগানিস্তানের রানের গতি বাড়ে ওমারজাই উইকেটে যাওয়ার পর। রাশিদের পর লিভিংস্টোন ও মার্ক উডকেও ছক্কা মারেন তিনি। এর মাঝেই ইব্রাহিম ষষ্ঠ ওয়ানডে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ১০৬ বলে। ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেঞ্চুরি করা আফগানিস্তানের প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার তিনি।
ওমারজাইয়ের বিদায়ে ভাঙে ৬৩ বলে ৭২ রানের কার্যকর জুটি।
এরপর ষষ্ঠ উইকেটে স্রেফ ৫৫ বলে ১১১ রানের বিস্ফোরক জুটিতে দলের স্কোর তিনশ ছাড়িয়ে নিয়ে যান ইব্রাহিম ও নাবি। শতক থেকে দেড়শতে যেতে ইব্রাহিমের লাগে কেবল ২৮ বল। বয়স ২৪ বছর পূর্ণ করার আগে ওয়ানডেতে দুটি দেড়শ ছোঁয়া ইনিংস খেলা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি।
শেষ ওভারে কেবল ২ রান দিয়ে দুজনকেই আউট করেন লিভিংস্টোন। তারপরও শেষ ১০ ওভারে ১১৩ রান তোলে আফগানিস্তান।
৩ ছক্কা ও ২ চারে ২৪ বলে ৪০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন ৪০ বছর বয়সী নাবি, পরে যা বড় ভূমিকা রাখল দলের জয়ে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ৩২৫/৭ (গুরবাজ ৬, ইব্রাহিম ১৭৭, সেদিকউল্লাহ ৪, রেহমাত ৪, শাহিদি ৪০, ওমারজাই ৪১, নাবি ৪০, নাইব ১*; রাশিদ ১*; আর্চার ১০-০-৬৪-৩, উড ৮-০-৫০-০, ওভারটন ১০-০-৭২-১, রাশিদ ১০-০-৬০-১, রুট ৭-০-৪৭-০, লিভিংস্টোন ৫-০-২৮-২)
ইংল্যান্ড: ৪৯.৫ ওভারে ৩১৭ (সল্ট ১২, ডাকেট ৩৮, স্মিথ ৯, রুট ১২০, ব্রুক ২৫, বাটলার ৩৮, লিভিংস্টোন ১০, ওভারটন ৩২, আর্চার ১৪, রাশিদ ৫, উড ২*; ফারুকি ১০-০-৬২-১, ওমারজাই ৯.৫-০-৫৮-৫, নাবি ৮-০-৫৭-২, রাশিদ ১০-০-৬৬-১, নুর ১০-০-৫১-০, নাইব ২-০-১৬-১)
ফল: আফগানিস্তান ৮ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: ইব্রাহিম জাদরান