স্টাফ রিপোর্টার:বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে আন্ধারী খালের উৎপত্তিস্থলে বিশাল রাবার ফ্যাক্টরি নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এতে স্থানীয় কয়েক হাজার পাহাড়ি বাঙালি জনসাধারণের কৃষি, মৎস্য চাষ ও দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের একমাত্র পানির প্রাকৃতিক উৎস আন্ধারী খালের পানি দূষণের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনগণ। (সংযুক্তি-১)
এছাড়া জায়গাটি জীববৈচিত্র্যের অন্যতম ’হট স্পট’ বলে বিবেচিত। পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় তিন সহস্রাধিক অনাথ, এতিম ও বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষালয় দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম কসমো স্কুল। এছাড়াও গত ২ যুগ ধরে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ করছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার ২০২৩ -এ ১ম পুরষ্কার লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও ২৫০ প্রজাতির বাঁশের সংগ্রহশালা গড়ে তোলা ছাড়াও জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আধার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে জায়গাটিকে। ৩০০ প্রজাতির পাখি ও ২০০ প্রজাতির প্রজাপতির আবাস এখানে। এই পাহাড়ি ছড়া থেকে ইতোপূর্বে বিলুপ্তপ্রায় ও বিপন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতির অবস্থান ও আবাসস্থল রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে লালমাথা কুচকুচি (Red- headed trogon) লাল বনমুরগি (Red Junglefowl), কালা মথুরা (Kalij Pheasant), উদয়ী বামনরাঙা (Oriental Dwarf kingfisher), চাদিবুক মেটেঠুটি (Silver-brasted Broadbill,), খয়রামাথা শুমচা (Hooed Pitta )সহ অসংখ্য বিপন্ন পাখি, প্রজাপতি ও বন্যপ্রানীর আবাস ও বিচরনস্থল ছিল ছড়াটি। (সংযুক্তি -২)
কিন্তু বর্তমানে লামা রাবার ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্যে পুরো জায়গাটির গাছপালা কেটে আগুন দিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার করা হয়েছে । ফলে এখানকার জীববৈচিত্র্য মারাত্নক হুমকির মুখে পড়েছে।
স্থানীয়দের লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের আন্ধারী খালের উৎপত্তিস্থলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর উদ্যেগে বিশাল রাবার ফ্যাক্টরি নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এতে স্থানীয় কয়েক হাজার পাহাড়ি-বাঙালি জনসাধারণের কৃষি, মৎস চাষ ও দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের একমাত্র পানির প্রাকৃতিক উৎস আন্ধারী খালের পানি দূষিত হতে শুরু করেছে। এর আগে পোলো খালের উৎপত্তিস্থলের কাছে আরেকটি রাবার ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্যে পোলো খালের পানি দূষণসহ মারাত্নক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছিল। (সংযুক্তি -৩)
উল্লেখ্য যে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রায় এক হাজার ছয়শত একর জমি আছে। কিন্তু তারা উক্ত জমিতে ফ্যাক্টরি স্থাপন না করে স্থানীয় জনসাধারণের একমাত্র পানির ব্যবস্থাকে দূষিত করে জনজীবনে দুর্ভোগ ডেকে আনছে। যদি আন্ধারী খালে উৎপত্তিস্থলে ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হয় তবে ফ্যাক্টরির বর্জ্য খালের পানিতে মিশে কৃষি কাজ, মৎস্য উৎপাদন ইত্যাদি ব্যাহত হবে। এছাড়া এ পানি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের ফলে সাধারণ লোকজন মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হবে।
তাছাড়া বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের ৫ শতাধিক মেয়ে শিশুর স্কুল ক্যাম্পাসটি নির্মাণাধীন ফ্যাক্টরির মাত্র ১৬০ মিটার পার্শ্বে হওয়ায় শিশু-কিশোররা মারাত্মক শব্দ ও বায়ু দূষণের শিকার হবে। এছাড়া ১৮০ মিটার দূরে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় ও আন্তর্জাতিক মানের জিমনেসিয়াম। (সংযুক্তি -৪) যেখানে প্রতিদিন শতাধিক জিমন্যাস্ট সুনিবিড় অনুশীলন করে। উল্লেখ্য, কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের জিমন্যাস্টিকস দলই বর্তমানে জাতীয় জিমন্যাস্টিকস দলকে প্রতিনিধিত্ব করছে; যারা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক জয় করে আনছে। ২০২১ সালে সিঙ্গাপুর ওপেন জিমন্যাস্টিকসে বাংলাদেশের অর্জনকৃত ২৫টি পদকের ২১টিই অর্জন করে এ স্কুলের জিমন্যাস্টরা।
উপজেলা প্রশাসন বরাবর অনতিবিলম্বে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নির্মাণাধীন ফ্যাক্টরি অন্যত্র স্থাপনের দাবি জানিয়ে এলাকাবাসী লিখিতভাবে আবেদন করেন।
আন্ধারী খালের পাশের মুরুং পাড়ার প্রধান কারবারী রুমতুই মুরুং বলেন, এই খালটি আমাদের জীবন জীবিকার অন্যতম সহায়ক। খালটি সুপেয় পানির একমাত্র উৎস। লামা রাবার এক হাজার ছয়শত একর জমি থাকতে খালের উৎপত্তিস্থলে এসে কেন ফ্যাক্টরি বানাতে হবে? তারা চায় আমরা সবাই চাষাবাদ করতে না পেরে এলাকা ছেড়ে চলে যাই? তারা জমি ও পাহাড় কাটছে।
সরই ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুল হালিম বলেন, লামা রাবারের উচিত অন্য স্থানে ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা। না হলে রাবার ফ্যাক্টরির বর্জ্য খালের পানি দূষিত করবে। বর্জ্য মিশ্রিত খালের পানি দিয়ে চাষাবাদ ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করলে মানুষ নানা রকম মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। আমি নিজেও এই খালের উপর নির্ভর। তাছাড়া দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এন্ড কলেজের কয়েক হাজার শিশু কিশোরও এই পরিবেশ দূষণের শিকার হবে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, এই ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হচ্ছে জনবসতি, আবাসিক ও স্কুল ক্যাম্পাসের খুব কাছেই। অনতিবিলম্বে ফ্যাক্টরি অন্যত্র স্থাপনের জোর দাবি জানান সরই এর জনগণ। এদিকে পাড়ার প্রধান কারবারী রুমতুই মুরুং এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ১৭ মার্চ সোমবার সকালে লামা প্রেস ক্লাবে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাত করে লিখিত আবেদনে অনতিবিলম্বে ফ্যাক্টরি অন্যত্র স্থাপনের জোর দাবি জানান।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ম্যানেজার মো. আরিফ হোসেন জানান, এখনো ফ্যাক্টরি নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছি, অনুমতি পেলে ফ্যাক্টরি নির্মাণের কাজ শুরু করবো।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবনের সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম জানান, লামা রাবার মালিক কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে একটি আবেদন করেছে আমি এলাকা পরিদর্শন করেছি সবদিক বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন বলেন, পরিবেশের ক্ষতি এবং পানির উৎস নষ্ট হয় এমন কাজ করতে দেয়া হবে না। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।